এমপি পদ নিয়ে বিতর্ক পদত্যাগের ঘোষণা লতিফ সিদ্দিকীর

দল থেকে নিজেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ দাবি করলেও নিজের সংসদ সদস্য পদের ব্যাপারে দলের কাছেই সিদ্ধান্ত চান বিতর্কিত সংসদ সদস্য সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকারের নিকট পদত্যাগ করে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটাবেন দাবি করেন। এতে ইসির আয়োজিত ওই শুনানির আর প্রয়োজন পড়বে না বলেও জানান। গতকাল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) অনুষ্ঠিত শুনানিতে অংশ নিয়ে শুনানি মুলতাবির আবেদন করে ইসিকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তাকে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে ইসি আগামী ২ সপ্তাহের সময় দিয়েছেন। তবে ইসিতে বিচারধীন থাকায় স্পিকারের নিকট তিনি পদত্যাগ করতে পারেন কি না এ নিয়েও আলোচনায় এসেছে। তা ছাড়া চলমান বিতর্কের মধ্যে স্পিকার তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। লিখিত জবাবের মতোই শুনানিতেও দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের দাবি জানান আওয়ামী লীগ।গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সভাকক্ষে বেলা ১১টায় শুনানি শুরু হয়। ইসির পূর্ব নির্ধারিত শুনানিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন, নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ, জাবেদ আলী ও মো. শাহনেওয়াজ এবং ইসি সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম ও আইন শাখার যুগ্ম সচিব মো. শাহজাহানের উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজে শুনানিতে না এলেও তার প্রতিনিধিত্ব করেন দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, সহ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছার ও সাইফুদ্দিন খালেদ।শুনানির শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য দিতে তার প্রতিনিধিদের বলেন। সে সময় লতিফ সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে আগে বক্তব্য দেয়ার অনুমতি চান। এরপর অনুমতি পেয়েই তিনি কমিশনকে বলেন, আমি এখান থেকে বের হয়ে গিয়েই পদত্যাগ করবো। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। শুনানিরও প্রয়োজন নেই। তার বক্তব্য শুনে কমিশন দুই সপ্তাহ পর শুনানির রায় দেয়ার ঘোষণা দেন।শুনানিতে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি সাচ্চা মুসলমান, আমি জন আস্থায় বিশ্বাস করি। জনতার আদালতে আমি গিয়েছি। আমি সংসদ সদস্য। আইনগতভাবে ও সাংবিধানিকভাবে সংবিধানের ৬৬ (৪) ধারা অনুযায়ী আমার বিষয়ে স্পিকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় আমাকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয়েছে।নিজের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে লতিফ বলেন, এর আগে ‘বহুবার’ দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও এমন শুনানিতে তাকে আগে কখনো আসতে হয়নি। দল থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি। বহুভাবে বহুবার বহিষ্কার হয়েছি। এভাবে আর কখনো হয়নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার, আমি আনন্দের সঙ্গে, নির্লিপ্তভাবে ঘোষণা করছি, আমি টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করব। এটা আমার ঘোষণা, আমার সিদ্ধান্ত। নির্বাচন কমিশনের এ শুনানির আর দরকার নেই। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে শুনানির মুলতবির আবেদন করে ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠিও নির্বাচন কমিশনে জমা দেন লতিফ সিদ্দিকী।  পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবির কাউছারকে শুনানিতে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি বলেন, নির্বাচনী আইন ও সংবিধান অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর আর সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকার সুযোগ নেই। তার সদস্য পদ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। এরপর লতিফ সিদ্দিকী সহাস্যে ডায়াসে গিয়ে আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন।এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ বলেন, তিনি আমাদের কাছে দু’সপ্তাহ সময় চেয়েছিলেন, আমরা দু’সপ্তাহ সময় দিয়েছি। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে এবং সেদিনই এর রায় হবে। তবে এর আগে তিনি পদত্যাগ করলে শুনানির বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবো। পরে সংসদের স্পিকারই বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন।নিয়ম অনুযায়ী, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার জন্য কোনো সংসদ সদস্য যদি স্পিকারের কাছে আবেদন করেন, স্পিকার তা গ্রহণ করে আসনটি শূন্য ঘোষণার ব্যবস্থা করে। আসন শূন্য হলে ইসি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে।এর আগে ইসিকে লিখিত চিঠিতে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে দাবি করেছিলেন দলের সাবেক এই প্রেসিডিয়াম সদস্য। এর বৈধতা নিয়ে তিনি আদালতেও যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে তিনি আদালত গড়িয়ে ফের ইসিতে আসেন। গতকাল তিনি ইসি থেকে বিষয় ফের সংসদে সমাধানের ঘোষণা দেন। তবে তার পদত্যাগপত্র স্পিকার গ্রহণ করবেন কি না তা নিয়ে ইসির কর্মকর্তারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, বিষয়টি অনেক বির্তক হয়েছে। তাই ইসিতে বিচারধীন বলে স্পিকার ইসিকেই সমাধানের দায়িত্ব দিতে পারেন। তবে ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, যেহেতু তার সংসদ সদস্য পদ নিয়েই বিতর্ক চলছে তার মানে তিনি এখনো সংসদ সদস্য। আর সদস্য পদের পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে দিতেই পারেন। এক্ষেত্রে ইসিতে বিচারধীন থাকা কোন বিষয় প্রাধান্য পাবে না। শুনানি থেকে বের হয়ে লতিফ সিদ্দিকী উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, আমি অবগত হয়েছি, আমার নেত্রী চান না, পদ নিয়ে যেন বাড়াবাড়ি করি। সংসদ সদস্য পদ কার কাছে কতটা মূল্যবান আমি জানি না। তবে আমার কাছে মূল্যবান হল জনগণের ভালবাসা ও নেত্রীর আস্থা এবং আনুগত্য। তাই আমি কমিশনকে বলেছি, এ মামলায় আমি লড়তে চাই না। এ শুনানি মুলতবি করা হোক। তিনি বলেন, আমি আমার পদত্যাগপত্র স্পিকারের কাছে পৌঁছে দেব। সংসদ সদস্য পদ নিয়ে লড়বার মতো দুর্বল মানসিকতা আমার নেই। আমি চাই, এদেশের কল্যাণ হোক। জঙ্গিবাদ, অনাচারের বৈষ্যমের রাজনীতি, হানাহানির রাজনীতি নির্মূল হোক। ন্যায় প্রতিষ্ঠা হোক। আমি আমার নেতার (শেখ হাসিনা) অনুগত, এ বিষয়ে আর আইনি লড়াই করতে চাই না। আজই স্পিকারের কাছে আমার সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিষয়ে চিঠি দিবো। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমি একজন সাচ্ছা মুসলমান। আমার ঈমানে এতটুকুও দুর্বলতা নেই, যা প্রচার হয়েছে তা মিথ্যা প্রচার হয়েছে।প্রসঙ্গত: গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী থাকাকালীন এক অনুষ্ঠানে হজরত মোহাম্মদ (সা.) পবিত্র হজ ও তাবলিগ-জামাত নিয়ে বির্তকিত মন্তব্য করেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। এরপর ইসলামী দল ও সংগঠনগুলো তার শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে। পরে দল ও মন্ত্রিপরিষদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এর পর তার সংসদ পদ নিয়ে জটিলতা তৈরি হলে গত ১৩ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিনকে চিঠি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে ১৬ জুলাই ইসি লতিফ সিদ্দিকীর অবস্থান ও এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয়। একই দিন সিদ্দিকীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকেও চিঠি দেয়া হয়।